যারা একাত্তরে লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষের গণহত্যাকে বিচ্ছিন্ন সহিংসতা বা গৃহযুদ্ধ বলে প্রচার করেন, দুই অঙ্কের কোটায় লোক মারা যাওয়ায় আজ সেটাকে তারা বলছেন গণহত্যা! দক্ষিণগামী রাজনৈতিক-মানবাধিকার তাত্ত্বিক ফরহাদ মজহার এ ঘটনাকে গণহত্যা আখ্যা দিয়ে তো বলেই ফেললেন যে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী নাকি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগের ২৫ বছরে এত মানুষ হত্যা করেনি যা শেখ হাসিনার সরকার শুধু ফেব্র“য়ারি মাসে খুন করেছে। অঙ্ক কষে বলতে হবে, পাকিস্তান আমলে তাহলে ষাট সত্তরজন লোককেও হত্যা করা হয়নি! ভ্রান্তিপূর্ণ এ দাবির মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে তিনি পাকিস্তানের সামরিক শাসনকেই উৎকৃষ্ট শাসন হিশাবে বৈধতা দিলেন।
তিনি তাঁর সাম্প্রতিক একটি লেখায় জানাচ্ছেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান নাকি চাকমা, মারমা মান্দিসহ অন্যান্য জাতিসত্তার টুঁটি চেপে ধরবে। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, জনসম্পৃক্তি ও বিশেষ রাজনৈতিক প্রেক্ষিতকে আমলে না নিয়ে যারা ভাষা তথা সাংস্কৃতিক উপাদানকে রাজনীতিকরণের সাথে সাম্প্রদায়িকতার সরল ও যান্ত্রিক সংযোগ স্থাপন করেন তারা যে ভ্রান্তির কানাগলিতে আটকে পড়েছেন সে কথা বলাই বাহুল্য। বাঙালির জাতিবোধের রাজনৈতিক ধারা আবশ্যিকভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠের আত্মপরিচয়ের রাজনীতি হয়ে উঠবে — এমন পরিণতিবাদী (teleological) কথা কেউ যদি ভাবেন তবে সেটা তাদেরই বুদ্ধিবৃত্তির অপুষ্টির লক্ষণ।
তিনি জামায়াতের এই তাণ্ডবকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই হিশাবে চিহ্নিত করেছেন। নরেন্দ্র মোদীকে গুজরাট গণহত্যায় উসকানি দেয়ার অভিযোগে যদি মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়, তার পক্ষে হাজারো শিবসেনা দেশজুড়ে তাণ্ডব চালাবে এবং পুলিশের উপর হামলা ও পাল্টা হামলার ঘটনায় সেখানেও হতাহতের ঘটনা ঘটবে। এখন তাণ্ডবটি সম্পর্কে কিছুই না বলে পরের ঘটনাটিকে গণহত্যা বলে প্রচার চালানোর মানে দাঁড়ায় পূর্বের হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটিকে এড়িয়ে যাওয়া।
জামায়াত-শিবির হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর বিনা প্ররোচনায় হামলা চালিয়েছে, দেশজুড়ে রাস্তাঘাটে তাণ্ডব চালিয়েছে, টার্গেট করে আচমকা গুলিবর্ষণ করে এমনকি ফাঁড়িতে হামলা চালিয়ে পুলিশ হত্যা করেছে। এ ঘটনাগুলো যেমন সত্য ঠিক তেমনি এটাও সত্য যে পুলিশ বেপরোয়া ও দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়ায় অনেক নিরাপরাধ লোকের প্রাণহানি হয়েছে। তার দায় প্রশাসনের ঘাড়ে না চাপিয়ে শাহবাগের আন্দোলনকারী এমন কি আন্দোলনের সাথে যারা সংহতি জানিয়ে লেখালেখি করছেন তাদের ঘাড়ে চাপানো এবং কূটতর্ক করে মানুষকে বিভ্রান্ত করার মতলব ছাড়া আর কিছু নয়।
পুলিশের এই নির্বিচার হত্যাকাণ্ড প্রকারান্তরে জামায়াত নেতৃবৃন্দের মনোবাসনাকেই পূর্ণ করল যারা গরিবদের ধর্মের নামে উত্তেজিত করে রাস্তায় নামিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে। মহামতি ফরহাদ মজহার জামায়াতের এই তাণ্ডবের প্রেক্ষিত বিচার না করেই ঘোষণা দিচ্ছেন এটা নাকি ইসলামের উপর আঘাতের প্রতিক্রিয়া মাত্র। এহেন প্রচার সেকুলার বনাম ইসলাম কিংবা আস্তিক বনাম নাস্তিক এই দ্বন্দ্বের মধ্যে ফেলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চক্রান্তেরই অংশ। এ মিথ্যা অপপ্রচার আজ মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তৎকালীন পাকিস্তানি রাষ্ট্রের সরকারি মিডিয়ার প্রচারকেও হার মানিয়েছে। তিনি পুলিশের এই হত্যাকে একাত্তরের গণহত্যার সাথে তুলনা করে একাত্তরের গণহত্যাকেই প্রকারান্তরে অস্বীকার, এমনকি খাট করছেন।
ডানপন্থী মিডিয়া জামায়াত-শিবির কর্তৃক হিন্দু নির্যাতনের ঘটনাগুলোকে এখন বেমালুম চেপে যাচ্ছে, তাদের কেউ কেউ বলছে এটা অপরাপর মিডিয়ার অপপ্রচার ছাড়া আর কিছু নয়। যারা গৃহযুদ্ধের জুজু দেখিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে বানচাল করতে চেয়েছে এখন তারাই দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর জন্য সচেষ্ট। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা না বলে অবশ্য সংখ্যালঘু উচ্ছেদ বা নিধন প্রচেষ্টা বললে যথার্থ হয়।
ফরহাদ মজহার শাহবাগের ফাঁসি চাই দাবিকে ‘পাবলিক লিঞ্চিং’ প্রচেষ্টার সমতুল্য বলে প্রচার চালাচ্ছেন। এটা ঠিক যে আন্দোলনকারীরা বিদ্যমান বিচার ব্যবস্থার উপর আস্থা রাখতে না পারায় জনগণ কেমন রায় চায় সেটাও জানিয়ে দিতে আপত্তি করছে না। এখন যারা বিচার স্থগিত করে রাষ্ট্র ও বিচার ব্যবস্থাকে আমূল সংস্কারের কথা বলছেন তারা এক হিশাবে বাঙ্গালিকে হাইকোর্ট দেখাতে সচেষ্ট হয়েছেন সে কথা বলাই বাহুল্য। আন্দোলনকারীরা যে বিচার ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন চায় না তা নয়, সেই দীর্ঘপ্রক্রিয়া বাস্তবায়নের পাশাপাশি তারা সমস্ত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের যে কোন মূল্যে দ্রুতবিচার নিশ্চিত করতে চায়। এমন প্রমাণিত অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি তারা চায়। যারা মানবতার দোহাই তুলে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তিকে রদ করতে চায় তারা তো এতদিন সর্বোচ্চ শাস্তি হিশাবে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার যে বিধান তার উৎখাতে সচেষ্ট হয়নি। কাজেই এখন মৃত্যুদণ্ড বিরোধিতার মানে দাঁড়ায় যুদ্ধাপরাধীদের যে কোন মূল্যে রক্ষা করে তাদের আবার রাজনৈতিক নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত করা।
একাত্তরে যে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সূচনা ঘটেছিল তারই ধারাবাহিকতা হিশাবে শাহবাগের আন্দোলনকে পাঠ করতে হবে। এর সাথে ফ্যাসিবাদের কল্পিত সম্পর্ক রচনা বুদ্ধিবৃত্তিক দুরাচারের লক্ষণ বৈ নয়। বরং ফ্যাসিবাদের মূল উৎপাটন করে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে সুনিশ্চিত করাই শাহবাগ আন্দোলনের লক্ষ্য। শাহবাগ আন্দোলনের সাথে সরকার আছে বটে কিন্তু আওয়ামী লীগের সমর্থনের দরুন এই আন্দোলনের তাৎপর্য কোনভাবেই ম্লান হয়নি। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না হওয়ায় যে কলঙ্কের দাগ এখনো আমাদের গায়ে লেগে আছে তা মুছে ফেলার ডাক দিয়েছে শাহবাগ। শাহবাগ আন্দোলন উগ্র জাতীয়তাবাদকে উসকে তো দেয়নিই বরং উগ্র জাতীয়তাবাদের সমালোচনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের আপন জাতিবোধের একটি জনসম্পৃক্ত ধারার রাজনৈতিক উত্থানের সম্ভাবনা তৈরি করেছে, যার উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধর্ম বর্ণ জাতি পেশার লোকজন একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী আকারে হাজির হতে পারে।
আর চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার দাবিটি একটি গণদাবি — কেবল তারুণ্যের অথবা বিশেষ কোন রাজনৈতিক দলের দাবি নয়। কাজেই শাহবাগ কেবলমাত্র তারুণ্যের প্রতিনিধি নয়, বরং মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষা তথা স্বাধীন সার্বভৌম শোষণ ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নকে লালন করে এমন সকল বয়সের সকল পেশার লোকের প্রতিনিধি হিশাবেই উপস্থিত শাহবাগ।
